ছোট গল্প

তুলা রাশি


বিকাল থেকেই ইদ্রিস মাষ্টারের মেজাজ খারাপ। ঘুম থেকে উঠে চায়ের সাথে তার নেভি সিগারেট চাই। চা আছে, সিগারেট নাই। প্যাকেট খালী। সিগারেট আনতে হেটে যেতে হবে মাইল দুয়েক বাজারে। এর মধ্যে শুনলেন তার স্ত্রী চিৎকার করে কাদতেছে। আল্লাগো আমার ঝুমকা দুইডা গেল কৈ! ঘটনা হল ড্রেসিং টেবিলের সামনেই তিনি ঝুমকা দুটো রেখে ছিলেন। তিন মিনিট হয়নি বাথরুম থেকে এসে দেখেন ঝুমকা দুটো নেই! কিছুক্ষনের মধ্যেই গ্রামময় পুরো ঘটনা রটে গেল। আমেনা বেগম উনার দুর সম্পর্কের চাচী হন। সব শুনে বললেন, ঝুমকা উদ্ধার দশ মিনিটের ব্যাপার। খালী তুলা রাশীর কাউকে খুজে বের করতে হবে। যেহেতু গ্রামের কেউ তাদের রাশী সম্পর্কে জানে না, অন্য গ্রাম থেকে তুলা রাশীর কাউকে আনতে হবে। আমেনা বেগমের তুলা রাশীর এক আত্নীয় আছেন। তিনি থাকেন তিন গ্রাম দূরে। তাকে আনতে টাকা পয়সা খরচ করতে হবে।
: চাচী আমনে আনেন। যত টেহা লাগে আনেন।
: হেরে আনতে ৫০০ টেহা লাগবো। যাওন আসনের খরচা।
: আনেন, আমনে হেরে আনেন।

যথা সময়ে তুলা রাশীর কালাম শেখ আসলো। গ্রামময় বাচ্চাদের কাছে এটা চরম উৎসবের দিন। কালাম শেখ একটা তামার বাটি হাতে নিয়ে ইদ্রিস মাষ্টারের ঘরের মাটিতে বাটিটা ঠেসে ধরল। তারপর দে দৌড়। আন্ডা বাচ্চার দল ছুটল তার পিছনে পিছনে। কালাম শেখ বাটি নিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে পড়ে যাচ্ছে । আবার উঠে দৌড়াচ্ছে। একবার গিয়ে পড়ল একটা পুকুরে। অলৌকিকভাবে সেখানেই ঝুমকা দুটো পাওয়া গেল। আবাল বৃদ্ধ বনিতা, সবার তুমুল করতালি। অবশেষে কালাম শেখতে ৫০০ টাকা দিয়ে বিদায় করা হল। আমেনা বেগমকেও ৩০০ টাকা দেয়া হল।

তারপর বেশ কিছু দিন কেটে যায়। বর্ষার মাস। সারাদিন বৃষ্টি। বাচ্চাদের দল মন খারাপ করে সারাদিন বাসায় বসে থাকে। এমনই একদিনে অজু করে বাতেন সাহেব উঠোনে এসেই অবাক! দীর্ঘ ১০ বছর লিবিয়া থাকার স্মৃতি একমাত্র ঘড়িটা নাই। জলচৌকির উপড়েই ছিল। ঘড়িটা গেল কোথায়? চল্লিশোর্ধ বাতেন সাহেবের ষোড়শ স্ত্রী গামছা নিয়ে স্বামীর কাছে আসলেন।
: ঘড়িডা কৈ?
: আমি কেমনে কমু, ঘড়ি কি আমার কাছে রাখছেন?
: গর্দভ মহিলা! ঘড়িডা জলচৌকির উপড়েই ছিল।
: কী কন! তাইলে গেল কৈ?
: এহনও বুঝতাছো না! উডান দিয়া কাউরে যাইতে দেখছো?
: না, আমি ঘরের মদ্যি ছিলাম।
: বুচ্ছি কী হইছে, তুমি একটা কাম করতে পারবা?
: কী কাম!
: আমি ঢাহা যাইতেছি। বড়পীড়ের কাছ থাইকা ডিম পড়া আনমু। গ্রামের সকলরে খাওয়ামু। তুমি গায়ে এইডা প্রচার কইরা দিবা।
ঘরময় আতরের গন্ধ। তার সাথে যোগ হয়েছে গোলাপ জলের ঘ্রান। একজন মুরীদ আইসা বাতেন সাহবের গায়ে ছিটিয়ে দিয়েছে। একটু ঝিমুনির মত আসছে। বাতেন সাহেব তার লিবিয়ার রবিবার রাতের সঙ্গিনীকে স্বপ্নে দেখলেন। লিবীয় বিধবা এই সঙ্গিনীই দেশে ফেরার সময় বাতেন সাহেবকে এই ঘড়িটা উপহার দিয়েছিলেন। একজনের ঝাকুনিতে তিনি জেগে উঠলেন।
: এই নেন আমনের ডিম।
: ঘড়িডা কি পামু?
: ডিমডা ভাজী কইরা গ্রামের সবাইরে একটু কইরা খাওয়াইবেন। যে চুরি করছে, নগদে রক্ত বমী কইরা মারা যাইবো।

ডিমের পুরো খোলসটা অজানা আরবী ভাষায় লেখা। বাতেন সাহেব তা দেখে বড়ই প্রীত হলেন। ডিমের উপর এত সুন্দর করে আরবী লেখা তিনি কখনোই দেখেন নাই।

গ্রামে ফিরলেন। বাড়িতে এসে দেখলেন তার স্ত্রী বড়ই হাসিখুসি। বাতেন সাহেব তার স্ত্রীর হাসিমুখে বড়ই বিরক্ত হলেন।
: বুচ্ছেন...আমনে যেই না ঢাহায় গেলেন..। আমি তো হারা গায়ে বইলা বেড়াইছি ..এ বড় কঠিন ডিম পড়া। চোর একটু খাইলেই রক্ত বমি কইরা মারা যাইবো। আমনে আসার ঘন্টা খানেক আগেই আমেনা বু ঘড়িডা দিয়া গেল। বলল হে নাকি আমনের লগে মশকরা করছে। আমেনা বুড়ে চিনছেন তো? ঐ যে কেমনে কইরা তুলা রাশীর লোক দিয়া ঝুমকা বাহির করল...

                                          ***********************************

জয়নাল গাজীর আত্নকাহিনী...

-আমাদের অংকের শিক্ষক নাই। আপনি শিক্ষিত মানুষ। চাইলে আপনাকে আমার স্কুলে নিতে পারি।
- অংক আমার বিষয় ছিল না। আমি ফিজিক্সের মানুষ। তাও পড়াশোনা করি না বাইশ বছর যাবত।
-নাইন টেনে অংক পড়াইতে তোর অংকে মাষ্টার্স করন লাগে না। আপনি পারবেন।
-আপনি বলছেন?
-জ্বি, আর না পারলেও কোন সমস্যা নাই। ফিজিক্সের মাষ্টারকে বাদ দিয়া দরকার হয় আপনাকে রাখবো। ঢাকা ইনভার্সিটির থাইক্যা পাশ দেয়া লোক আপনি। আপনি থাকলে আমার স্কুলটা খুব দ্রুত এমপিও ভুক্ত হইবো।
- কাউকে বাদ দেয়া লাগবে না। আমি অংকই পড়াবো।
-আলহামদুল্লিাহ। তা আপনাকে কত দিতে হবে?
-আমার টাকার দরকার নাই। তবে সিগারেটের অভ্যাস থাকায় কিঞ্চিত টাকার প্রয়োজন। দৈনিক পঞ্চাশ টাকা দিলেই আমার চলবে।
- আপনাকে মাসে ৪০০০ টাকা দেয়া হবে। থাকবেন স্কুলের দোতলায়। অনেকগুলো কামরা খালি আছে।
- ধন্যবাদ।

জয়নাল গাজী এখন বড়াইবাড়ি গার্লস স্কুলের অংকের জনপ্রিয় শিক্ষক। এই এলাকায় উনার আগমন বছর ছয়েকের মত। তার সম্পর্কে বিস্তারিত কেউ কিছু জানে না। তবে প্রধানশিক্ষক ছদরুদ্দিন সাহেব কিছুটা জানেন। উনিই জয়নাল গাজীকে স্কুলের চাকরীটা দিয়েছিলেন।
জয়নাল গাজীর আজ ঘাগড়া শাক খাওয়ার ইচ্ছা হল। এই শাকের একটা সুবিধা হল এটা কেনা লাগে না, রাস্তার দু ধারেই গজায়। অসুবিধা হল এর গন্ধ, কিন্তু বিচি শিম দিয়ে শাক রান্না করলে হয় অমৃত। শুক্রবার জুমার নামাজের পর প্রধান শিক্ষক জয়নাল গাজীর স্কুলের রুমে আসেন। গল্প করেন। যা রান্না হয়, উনি তাই খান।
- তারপর গাজী সাব. আইজকা আপনার আইটেম কি?
- ঘাগড়া শাক, ডিম ভর্তা।
- ভাল, খুব ভাল আইটেম। আইজ রাইতে ঢাকায় যামু, আমনার কোন খবর থাকলে বলেন।
- আমার কোন খবর নাই।
- আচ্ছা ভাবীর কথাগুলান আবার বলেন। আমি ভাইবাই পাইনা গাজী সাব, ভাবী কেমনে এই কাম করল! শিক্ষিত্ মেয়ে..
- আপনার ভাবীর দোষ ছিল না, আমার বেশ কিছু ভুল ছিল।
- আমনার ভুল ছিল? ফিরিস্তার মতন মানুষ আমনে...
- আপনার ভাবী ব্রিটিশদের মত divide& rule স্ট্রাটেজি নিয়েছিল।
- বুঝলাম না।
- আমাকে আমার মা, ভাই বোন সবার কাছ থেকে আলাদা করার সে কৌশল নিয়েছিল। আমি বুঝতে পারি নি। মাঝে মাঝে আমার ভাই বা বোনরা বাসায় এলে, সে তুচ্ছ বিষয় নিয়ে তাদের সাথে ঝগড়া করত, আমার মা, ভাই বোনদের নিয়ে উল্টা পাল্টা কথা বলত। আমি অন্ধের মত তার কথা বিশ্বাস করতাম। আমিও একসময় চাইতাম না তারা কেউ এ বাসায় আসুক। এক সময় কেউ আর আমার সাথে কোন যোগাযোগ রাখল না। আমি সংসারে শান্তির জন্য সবার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করলাম। এভাবেই চলছিল বেশ কিছুদিন। জানেন, আমার একটা মাত্র মেয়ে ছিল। আমি আমার সবকিছু, জমি বিক্রির টাকা সব আমার মেয়ের নামে লিখে দিলাম। আমার বউও চাকরী করত। আমার চাইতে ভাল বেতনের। চাকরীটা আমিই দিয়েছিলাম। একটা এম্বেসীতে। জয়েন করার পর তার প্রথম বক্তব্য কি ছিল জানেন?
- কি?
- ‘আমি আমার বেতনের এক টাকাও তোমাকে দিব না’
আমি হাসলাম। আমার প্রয়োজনও ছিল না। কোনদিন সংসারে তাকে এক কেজি লবনও কেনা লাগেনি। কিন্তু তারপরও আমি সংসারে সুখী হতে পারলাম না।
- কেন?
- টুকটাক বিষয় নিয়ে ঝগড়া লেগেই থাকত। একদিন জানাল, সে কানাডা থাকতে চায়। এদেশে আর থাকবে না। আমি রাজী হলাম না। মেয়েকে নিয়ে সে একাই চলে গেল কানাডা।
- বলেন কি!
- যেহেতু সবার সাথে সম্পর্ক শেষ হয়ে গিয়েছিল, কাউকে কিছু বললামও না। কেউ কোন খোজখবরও নিত না। এক সময় মনে হল, অনেক হয়েছে। এক ড্রেসেই হাটা শুরু করলাম, রেল স্টেশনে ঘুমিয়েছি। একসময় ভাসতে ভাসতে আপনার ঘাড়ে চাপলাম।
- ভাবী আর কোন যোগাযোগ করেনি?
- হয়ত করেছে, আমি কোথায় আছি এটা কেউ জানে না। আমি চাইনা কেউ জানুক। আপনি বিশ্বাস করেন আর নাই করেন, আমি এখানে অনেক শান্তিতে আছি।
                                              ************************

গ্যাসফিল্ডের আত্নকাহিনী কিংবা একজন টুরিষ্ট গাইড

চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ। তিন বছর মেয়াদ। ষোলমাসের মধ্যেই কাজ শেষ। চাকরী নট। শেষ মিটিং। ওয়ান টু ওয়ান মিটিং। আমি আর হেড অব এশিয়া প্যাসিফিক। এত রুইকাতলা থাকতে আমাকে কেন মিটিংয়ে ডাকা হল তা নিয়ে টেনশন। আমি বসে আছি। স্যার বেশ কিছুক্ষন চুপ থেকে বললেন,
- এটা তোমার সাথে আমার শেষ দেখা।
- জ্বি স্যার।
- তোমার সব পাওনা পেয়েছো?
- জ্বি স্যার।
’হুম’ বলে আবার চুপ। গ্লাস হাতে রঙ্গিন পানি। পিয়ন এসে বরফ দিয়ে গেছে। এক চুমুক খেয়ে ল্যাপটপে কি যেন দেখছেন।
- রমিজ, একটা সুখবর আছে। বলতো কি?
- আরেকটা গ্যাস ফিল্ডের কাজ পেয়েছেন স্যার?
- না। নাসডাকে আমাদের কোম্পানির শেয়ারের দাম ২৭% বৃদ্ধি পেয়েছে।
- খুব ভাল স্যার।
- তোমাকে বেশ কিছু সেনসিটিভ কথা বলার জন্য এখানে ডেকেছি। আমি এর আগে ইন্ডিয়ায় ছিলাম। সেখানেও শেষ দিন তোমার মতই একজনকে এরকম কথা বলেছিলাম। এটা আমার হেবিট।
- কি স্যার?
- তার আগে বল, তোমাদের দেশের মন্ত্রী এমপি সম্পর্কে তোমার ধারনা কি?
- ক্ষমতার বাইরে থাকলে এরা বেশ জনদরদী। অবশ্য ক্ষমতায় থাকলে ভিন্ন কথা।
- যেমন?
- স্যার ক্ষমতার বাইরে থাকলে এরা সাংবাদিকদের বলে সাহসী হতে, আর ক্ষমতায় গেলে বলে দায়িত্বশীল হতে।
- একটা বিশেষ গুনও কিন্তু তাদের আছে। শুধু ফরেনাররা এটা টের পায়।
- সেটা কি স্যার?
- এরা বেশ উদার।
- বলেন কি স্যার!! সেটা কি করে সম্ভব?
- এদেশের কাজটা পাওয়ার আগে ইন্ডিয়া, নেপাল সহ অনেক দেশেই আমাদের গ্যাসফিল্ডে আগুন ধরেছিল। এবং এটা জানার পরেও তোমাদের মন্ত্রী সাহেব আমাদের কাজটা দিয়েছিলেন।
- আমাদের প্রোপেজাল ভাল ছিল বলেই দিয়েছিলেন। ৮০% গ্যাস সরকার পাবে যা আন্তর্জাতিক মূল্যেরও অনেক কম দামে।
- ঐ দামে গ্যাস দিলে কোম্পানি দেওলিয়া হয়ে যেত।
- তবে এত কম প্রাইস কেন বিড করেছিলেন স্যার?
- আমরা জানতাম গ্যাস আমরা তুলবই না। প্রাইসতো অনেক পরের বিষয়।
- আগেই জানতেন!
- হুম। তুমি কি জানো কোন দেশে আগুন লাগলে ঐ দেশে যেসব গ্যাস এক্সপ্লোরেশন কোম্পানি আছে, বহির্বিশ্বে তাদের শেয়ারের দাম বাড়ে?
- বলেন কি স্যার! ...তবে কি আমাদের গ্যাস ফিল্ডে...?
- হুম, আমরাই আগুন লাগিয়েছি।
- কিন্তু স্যার এত যন্ত্রপাতি নষ্ট হল, বিনিয়োগের টাকা নষ্ট হল, কত মানুষ মারা গেল, বাড়িঘর থেকে উচ্ছেদ হল।
- কোম্পানির এক টাকাও নষ্ট হয় নি। সব বীমা করা ছিল। গ্যাস তুললে আমাদের লস হত প্রায় ৫ মিলিয়ন ডলার। কিন্তু এখন বীমা কোম্পানির কাছ থেকে আমরা পাব ৭ বিলিয়ন ডলার। বিনিয়োগ ১ বিলিয়নম, প্রফিট ৬ প্লাস শেয়ারের দাম ২৭% বৃদ্ধি।
- কিন্তু স্যার বীমার টাকাতো বাংলাদেশ সরকারের পাওয়ার কথা।
- না। চুক্তিতেই বলা ছিল বীমার টাকা কোম্পানি পাবে।
- বলেন কি! সম্পদ ধ্বংস হলো এদেশের, মানুষ মরল এ দেশের। আর বীমার টাকা পাবে কোম্পানি!!
- হুম। একশত ভাগ সঠিক।
- এ চুক্তি সরকার করল কিভাবে?
- ঐ যে বললাম, এরা খুব উদার। প্লাস একটা ব্রান্ড নিউ কার জায়গামত গিফট দিয়েছিলাম।
আমি বেশ কিছুক্ষন ঝিম মেরে বললাম, ’কিন্তু স্যার, এত সেনসিটিভ কথা আমাকে বলে দিলেন’?
- তোমাকে বললাম, কারন তোমার কথা কেউ বিশ্বাস করবে না। তুমি শুধুই একজন টুরিষ্ট গাইড।
- জ্বি স্যার।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন